বিশ্বে সাইট্রাস (লেবুজাতীয় ফল) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফল। উৎপাদনের দিক থেকে পৃথিবীর ফলগুলোর মধ্যে এর স্থান দ্বিতীয় কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দিক থেকে এ ফলের স্থান প্রথম (স্যামসন, ১৯৮৬)। বাংলাদেশের আবহাওয়া লেবুজাতীয় ফল (বিশেষ করে এলাচিলেবু, কাগজিলেবু, জাম্বুরা বেশি ভালো হয়) উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। এ দেশে লেবুজাতীয় ফলের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন। এ দেশের লেবুজাতীয় ফলচাষিরা প্রতি বছর রোগবালাই ও পোকামাকড় দ্বারা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই যেসব রোগ ও পোকা বেশি আক্রমণ করে উহার লক্ষণ ও প্রতিকার দেয়া হলো-
(অ) রোগবালাই
ডাই-ব্যাক (Dic-back) : লেবু জাতীয় ফসলের এটা একটি মারাত্মক রোগ। এ রোগের কারণে প্রতি বছর লেবুর ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে। এ রোগ কোলিট্রোটিক্যাম গোলিওসপোরডিস (Colletotrichum gloesporiodes) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।
লক্ষণ : ১. পাতার শিরাগুলো হলুদ হয়ে যায়। ২. সম্পূর্ণ পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে। ৩. শাখার অগ্রভাগ এবং ছোট ছোট প্রশাখাগুলো পুড়িয়ে যাওয়ার মতো দেখা যায় ও নিচের দিকে ঝুলতে থাকে। ৪. আক্রান্ত গাছের আকার ছোট দেখা যায়। ৫. কিছু দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ গাছ মরে যায়।
দমন : ১. উন্নত পরিচর্যা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। ২. প্রয়োজনীয় পরিমাণ পটাশ ও দস্তা সার প্রয়োগ করতে হবে। ৩. ফল সংগ্রহের পর বাগানের আবর্জনা এবং যদি আক্রান্ত অংশ থাকে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ৪. ডাইথেন-এম-৪৫ পানিতে ০.৩ % হারে মিশে ১০-১২ দিন পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
স্ক্যাব (Scab) : লেবু গাছের সর্বত্রে এ রোগ দেখা যায়। এ রোগের কারণে ফলের উপরিভাগ অত্যন্ত বিশ্রী হয়ে যায় এবং বাজারমূল্য কমে যায়। ইলন্সিনও ফাউসেটি (Elsinoe fawcetti) নামক এক প্রকার ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
লক্ষণ : ১. পাতা, কচি ডাল ও ফলের ওপর পানি ভেজা দাগ দেখা যায়। ২. অনিয়মিত দাগগুলো পাতা ও ফলের ওপর উঁচু এবং ফোস্কারমতো দাগ মনে হয়। ৩. ফলের ওপর প্রথমে হলুদ এবং কমলা বা লালচে চকচকে দাগ দেখা যায়। ৪. অনেক ছোট দাগ একত্র হয়ে খসখসে কর্কের মতো হয়ে যায় ও ফলের বাজারমূল্য কমে যায়।
দমন : ১. রোগাক্রান্ত পাতা, ডালপালা, ফল সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে। ২. জিংক সালফেট ও ছাই বর্ষার আগে গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে প্রয়োগ করতে হবে। ৩. বোর্দোমিক্সার এবং ফানজিসাইট (যেমন- কুপরাভিট ০.৩ % হারে ২-৩ বার প্রয়োগ করতে হবে) স্প্রে করতে হবে।
ক্যাংকার (Canker) : জেনথোমোনাস এক্সোনোপোডিস (Xanthomonas axonopodis pv. citri) নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
লক্ষণ : ১. ছোট ছোট পানি ভেজা দাগ পাতা ও ফলের ওপর দেখা যায়। ২. এ দাগগুলো সামান্য বিকৃত হয়ে বড় বাদামি বর্ণ ধারণ করে। ৩. দাগগুলো ফোস্কারমতো মনে হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফেটে যায়। ৪. ফলের ওপর ক্যাংকার হলে হলুদ রঙ বিদ্যমান বেষ্টনী দেখা যায়।
দমন : ১. সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত চারা গাছ নতুন এলাকায় রোপণ করতে হবে। ২. রোগাক্রান্ত ডাল-পালা কেটে ফেলতে হবে। ৩. বাগান পরিষ্কার রাখতে হবে। ৪. নিমের পাতার রস ১ কেজি প্রতি ২০ লিটার পানিতে মিশে ¯েপ্র করতে হবে। ৫. ডাইথেন এম-৪৫ কীটনাশক ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশে ¯েপ্র করতে হবে।
অ্যানথ্রাকনোজ (Anthracnose) : এ রোগ দুই প্রকার ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।
লক্ষণ : ১. পুরনো পাতা বা কিছু বয়স্ক হয়েছে এমন পাতায় ঈষৎ সবুজ রঙের দাগ পড়ে। ২. দাগগুলো শিগগিরই বাদামি বর্ণ হয়ে যায়। ৩. আক্রান্ত পাতা ও ডাল আগা থেকে শুকিয়ে যায় বা মরে যায়। ৪. আক্রান্ত গাছে অসংখ্য পত্রবিহীন মৃত বা অর্ধমৃত অথবা রোগাটে ডাল পাওয়া যায়। ৫. গাছে ফল থাকলে ফলের বোঁটা সংক্রামিত হয়ে পড়ে। ৬. আক্রান্ত ফলের ওপর বাদামি বর্ণের দাগ পড়ে এবং গুদামে সংরক্ষণ করলে ফল পচে যায়।
দমন : ১. নীরোগ বীজতলা থেকে চারা উৎপাদন করে নীরোগ বাগানে রোপণ করতে হবে। ২. চারা রোগমুক্ত রাখতে ৪ ঃ ৪ ঃ ৫০ হারে রোজিন বোর্দোমিক্সচার জানুয়ারি ও সেপ্টেম্বর মাসে এক বার করে ¯েপ্র করতে হবে। ৩. সুষম সার ব্যবহার করলে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। ফল সংগ্রহ করে আবর্জনা পুড়ে ফেলতে হবে। ৪. ছত্রাকনাশক যেমন ডাইথেন এম-৪৫ পানিতে ০.৩ % হারে মিশে স্প্রে করতে হবে।
(আ) পোকা দমন
লেবুর প্রজাপতি (Lemon butter fly)
ক্ষতির প্রকৃতি : এ পোকার কীড়া বা ক্যাটারপিলার পাতার ওপরে বসে পাতা খেতে থাকে। এরা অনেক সময় গাছকে নিষ্পত্র করে ফেলে। এজন্য ফল ও গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
প্রতিকার : ১. ডিমসহ পাতা সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে। ২. ডাইমেক্রন ১০০ ইসি ১৫ মিলি অথবা সেবিন ৮৫ এসপি ১৪ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে মিশে ¯েপ্র করতে হবে।
লেবুর পাতার ক্ষুদ্র সুড়ঙ্গ পোকা বা আঁকি পোকা (Citrus leaf miner)
ক্ষতির প্রকৃতি : লেবু গাছে প্রায়ই এ পোকা দেখা যায়। মাঝে মাঝে এরা কচি কমলা গাছে ক্ষতি করে থাকে। পোকার কীড়াগুলো পাতার ওপরের এপিডার্মিসের ঠিক নিচে আঁকবাঁকা সুড়ঙ্গ করে খেতে থাকে। এতে পাতা কুঁকড়ে বা মুড়িয়ে যায়। অনেক সময় পত্রফলকটি মুড়ে যায়। ফুলধারণ অবস্থায় এ পোকা আক্রমণ করলে গাছে মারাত্মকভাবে ফলধারণ ব্যাহত হয়।
প্রতিকার : ১. আক্রান্ত পাতার সংখ্যা কম হলে সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে। ২. আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি ১৭ মিলি ০.৩ % হারে অথবা ডাইমেক্রন ১০০ ইসি ১৫ মিলি অথবা ডায়াজিনন ৬০ ইসি ২০ মিলি ১০ লিটার পানিতে মিশে স্প্রে করতে হবে।
লেবুর পাতার ছাতরা পোকা (Citrus mealy bug)
ক্ষতির প্রকৃতি : কাগজিলেবু, জাম্বুরা, এলাচিলেবু ইত্যাদি গাছে ছাতরা পোকা দেখা যায়। এ পোকার আক্রমণে পাতা ও শাখায় তুলার মতো সাদা স্তূপ দেখা যায়। এ পোকা প্রশাখা ও পাতা থেকে রস চুসে খায়। আক্রান্ত অংশে ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী থাকে।
প্রতিকার : খুব কম আক্রমণ হলে আক্রান্ত প্রশাখা কেটে পুড়ে ফেলতে হবে। ২. ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি ১২ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশে স্প্রে করতে হবে।
কৃষিবিদ ড. এম এ মজিদ*
*পিএইচডি গবেষক, রাবি, প্রভাষক কৃষি শিক্ষা বিভাগ, নাটোর সিটি কলেজ, নাটোর, মোবাইল : ০১৭২২-৪০৩২২০